হাসানের সাথে সেদিনও আমার অন্যবারের মত খুব সাদামাটা ভাবেই দেখা হয়েছিল, একমাসের অস্থির অপেক্ষার পর দেখা করতে যাওয়া । আমার এখনো মনে আছে সে রাতে আমি একদম ঘুমাতে পারিনি রাত ধরে কি পরে যাবো গিয়ে কি বলবো সব ভাবতে ভাবতে কখন যে আমার ঘুম উড়ে গেছে নিজেও বুঝতে পারিনি । সব কিছুতেই কেমন যেন ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলাম - মনে হচ্ছিল সূর্যটাও বুঝি আমাকে কষ্ট দিতেই দেরী করে জাগছে আজ ।
সম্পর্কের শুরুটাতেই আমরা ঠিক করেছিলাম প্রতিমাসে একবার দেখা করবো, তাই হয়তো দেখা করার প্রতিটি মুহূর্ত খুব ছোট্ট মনে হতো । সেদিন গিয়েই দেখি ও সাদা শার্ট পরে দাড়িয়ে আছে, ভাললাগার মিষ্টি বাতাস এসে যেন মনটা আমার ভরে দিল মুহূর্তেই ।তারপরও একটু খোঁচা দেয়ার লোভটা সামলাতে পারলাম না । গিয়েই বললাম আমার সাথে ম্যাচিং করে গোলাপী প্যান্ট শার্ট পরনি কেন ! হাসান রাগী রাগী মুখ করে করে তাকাচ্ছ আর আমি সেই মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট করে হাসি সামলাচ্ছি । কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারলাম না তোমাকে গোলাপী শার্টে কল্পনা করেই হাসতে হাসতে আমি অস্থির । আমি এমনিতেই মেয়ে হিসেবে খুব শান্ত কিন্তু কেন যেন হাসানের পাশে থাকলেই সব দুষ্টামি একসাথে আমার মাথায় ভর করে ।
সারাদিন দুজনে মিলে খুব ঘুরাঘুরি করলাম, একসাথে খেতে গেলাম । মাঝখানে একবার হাসান বলেছিল "ইরা তোমার হাতটা একটু ধরা যাবে?" আমি বলেছি না ধরা যাবেনা । বেচারা খুব মন খারাপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে -ওর মুখ দেখে আমার কি যে মায়া লাগল আমার। গিয়ে ওর হাত ধরলাম, ও চোখ মুখ উজ্জ্বল করে বাচ্চাদের মত শুভ্র হাসিতে আমার হাত শক্ত করে ধরে বলছিল আর ছাড়বোনা কিন্তু বলে দিলাম। সাথে সাথে আমার মনে হলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে সূখী মেয়ে বোধহয় আমি । মনে মনে বলছিলাম - বিয়ের পর সারাক্ষণ আমি তোমার হাত ধরে থাকবো । তোমাকে যে আমি কি পরিমাণ ভালবাসি তা হয়তো তুমি কখনোই জানবেনা ।
দিনটা চোখের পলকেই যেন পুরিয়ে গেল, হাসানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরছি। পুরো সত্তায় যেন হাসানের উপস্থিতি জুড়ে আছে, তার ভাবনায়ই সারা পথ আচ্ছন্ন ছিলাম । মানুষ মজা করে বলে কারো হাসির জন্য মরার কথা কিন্তু আমি জানি হাসানের এক টুকরো হাসি দেখতে আমি চোখ বন্ধ করে কুয়ায় ঝাপ দিতে দ্বিধা করবোনা । একটা মাস ওকে না দেখে থাকতে হবে এই কষ্টটাই যেন আমার পৃথিবী এলোমেলো করে দিচ্ছে , নিজেকে সান্তনা দিচ্ছি আর বলছি একটা মাত্র বছর তারপরিতো আমরা বিয়ে করবো । তখন একটা দিনও আমি হাসানকে ছেড়ে কোথাও থাকবোনা ।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বাসার সামনে চলে এসেছি নিজেও জানিনা । গেটে ঢুকার সাথে সাথে মা এসে বললেন এতো দেরি করে ফিরলি কেন, দেখি তোর মোবাইলটা দেতো । হাসানকে কল করতে হবে তাই বল্লাম একটু পর দেই মা, কিন্তু মা বললেন না আমার এখুনি লাগবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের হাতে মোবাইলটা দিলাম । ঘরে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছি বাসা ভর্তি অপরিচিত সব মানুষ। মা দ্রুত এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন , তারপর ফিসফিস করে যা বললেন তার সারমর্ম হলো আজ আমার বিয়ে । ছেলেরা কবুল পড়িয়ে একসাথে চলে যাবে, আমি যেন উলটা পালটা কিছু করার কথা স্বপ্নেও না ভাবি । উলটাপালটা কিছু করলে বাবা সহ্য করতে পারবেন না আর বাবার কিছু হলে আমিই দায়ী। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম মা তুমিতো হাসানের কথা জানো এসব কি বলছো । মা আমার কথা জবাব না দিয়ে ছোট খালাকে বললেন ওকে দেখে রাখ,ও যেন এই ঘর থেকে বের হতে না পারে ।
তারপর হৈচৈ করে কতগুলো অপরিচিত মানুষ রুমে ঢুকল ।কি সব বলল কিছুই আমার মাথায় ঢুকেনি , শুধু সব শেষে সবাইকে আলহামদুলিল্লাহ পড়তে দেখলাম হাসি হাসি মুখে । ঘোরের মাঝেই যেন সব ঘটে গেল আমি কেমন শূন্য জগতে ভাসছি আর ভাবছি হাসানকে আমার কল করতে হবে । সবশেষে মাকে বললাম মা আমি শুধু একটা মিনিট কথা বলব , প্লিজ মোবাইলটা দাও । মোবাইল হাতে দিয়ে মা পাশে দাড়িয়ে আছেন আমি কল করে শুধু আমার বিয়ে হয়ে গেছে এই কথাটাই জানাতে পারলাম ।
পুরো রাত আমি শুধু আত্মহত্যার কথাই ভেবেছি, কিন্তু আমার ছোট বোনটার জীবন নষ্ট করার এই পথ বেচে নিতে পারিনি । হাসানের কাছে পালিয়ে যাওয়ার কোন পথও আমার খোলা ছিল না পরিবারের বড় মেয়ে হয়ে পরিবারের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারিনি । আমিতো মেয়ে, নিজের সব আত্মত্যাগ দিয়েই আমাকে বাচতে হবে এই কথাটা ছোট বেলা থেকেই শুনে এসেছি তারপরও এই মুহূর্তে সব ভুলে নিজের সুখটা বেচে নিতে ইচ্ছে করছিল । কিন্তু পারিনি শেষ পর্যন্ত সমাজের নিয়মটাই মেনে নিলাম ।
হাসানের হাত ধরে পথে পথে হাটার স্বপ্ন আমার স্বপ্ন হয়ে উড়তে লাগল...
হাসানের হাত ধরে পথে পথে হাটার স্বপ্ন আমার স্বপ্ন হয়ে উড়তে লাগল...
No comments:
Post a Comment