অর্কের মুখটা ইদানিং আমার আর ঠিক করে মনে পড়েনা। অর্ক কোথায় আছে কেমন আছে কিছুই জানা হয়না আর আগেরমত। অথচ একটা সময় কি অদ্ভুত ছিলো-ওর সাথে একদিন কথা না হলেই মনে হতো নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে বুঝি কথা হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রচন্ড অস্থিরতায় ভুগতাম আর ফাইনালি যখন কথা হতো তখন বুঝতে পারতাম চরম উত্তেজনায় কাপছে বুকের ভিতরটা। ওর ছোট্ট মেসেজগুলো অদ্ভুত ভালো লাগার জন্ম দিতো আমার ভিতর, ওকে নিয়ে কেমন যেন ঘোর লাগা নেশা কাজ করতো আমার মাঝে -ওকে ভাবতে ভাবতে কিভাবে সময় কাটিয়ে দিতাম নিজেও জানিনা।
শুধু জানতাম আমার সবটা জুড়ে অর্কের আনাগোনা ছিল। আমার সব অনুভুতিগুলো ও একাই কন্ট্রোল করতো। ও একটু প্রশংসা মনে হতো সাত আসমান ফুড়ে উপরে উঠে যাই। কি ছেলেমানুষই না ছিলাম তখন!
কতবার যে মনে হয়েছে “ইশ কোনভাবে যদি ওর হার্টটা খুলে মনের ভিতরটা বুঝতে দেখতে পারতাম। তখনো বুঝতে পারিনি আমাকে নিয়ে অর্কের অনুভুতি, এখনো জানিনা ও কি সত্যিই কখনো ভালোবেসেছিলো আমাকে। ভালোবাসলে কি এত সহজে ছেড়ে চলে যাওয়া যায় !
ছোট থেকেই আমি ভিষণ নারীবাদী। সব কিছুতেই আমার ছেলেমেয়েদের সমান অধিকার বলে তর্ক করার অভ্যাস ছিলো। পুরুষবাদী সমাজের নানা দিক দেখিয়ে প্রায়ই ঝগড়া শুরু করতাম ওর সাথে, ও মুচকি হেসে আমার সব যুক্তি মেনে নিতো। রাগ করে বলতাম “তোরা সব পুরুষ একি পালের ভেড়া, ও হ্যা হাসতে হাসতে বলতো হ্যা আর তুই হলি আমার একমাত্র ভেড়ি। বোকাটা ঝগড়াও করতে জানতো না ।
মা কোথাও গেলেই হাসি হাসি মুখ করে চলে আসতো “কিরে ভেড়ি রান্না কিছু করেছিস? চা খাওয়াবি না?! বলে নিজেই কিচেনে গিয়ে চা বানিয়ে নিতো।
মাঝে মাঝে “কিরে আন্টিতো দেখছি কিচ্ছু রান্না করেন নি, খাবি কি তুই”! বলে নিজেই রান্না চড়িয়ে দিতো। আমি কিচেনের দরজায় দাড়িয়ে ওর কান্ড দেখে দেখে খুব হাসতাম। খেতে বসলেই শুরু হতো ওর “এই খুব মজা হয়েছে না রে? এরকম রান্না আর জীবনে খেয়েছিস?” আমি হাসতে হাসতে বলতাম হ্যা রে দারুন হয়েছে তোর বউ খুব খুশী হবে। ও তখন বলোতো “আমার বউতো হবি তুই’। আমাকে বিয়ে করলে এমন রান্না সারাজীবন খেতে পারবি। কি রাজীতো? ”
আমি শুনেই মুখ বাকাতাম, ও সাথে সাথে বলতো “অবশ্য আমি বিয়ে বিয়ে না করলে তোকে বিয়ে করবেই বা কে! চেহারার ছিরিচাদ নেই,তার উপর রান্নাবান্নাও জানিস না কিছু ।
আমি ভীষণ রাগ করে বলতাম, যাহ ! আমি বিয়েই করবো না। ও সাথে সাথে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তো ” এই আমার কি হবেরে !! আমিতো বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে গেলাম। ওর চেহারা দেখে আমি হাসতে হাসতে বলতাম ঠিক আছে! কি আর করা, সমাজ সেবা হিসেবেই নাহয় আমি তোর গলায় মালা ঝুলাবো।
অর্কের আকাশ কখনোই খুব একটা পছন্দের ছিলোনা। আমার আকাশ ভালো লাগতো বলে প্রায়ই বলতো ‘একটু ছুতে না পারলে এ কেমন ভালোলাগা রে ?! আমারতো বৃষ্টি প্রিয় । বৃষ্টিতে মাখামাখি করার মজাই অন্যরকম “। তারপর আমার দিকে ঝুকে ফিসফিস করে বলতো ” তুই আমার বৃষ্টি হবি ? ভালোবাসায় মাখামাখি করে রাখবিতো আমাকে ?” কথাগুলো বলার সময় অদ্ভুত ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে । নিজের বুকের ভিতর ঢিপঢিপ শব্দ স্পষ্ট হয়ে কানে লাগতো আমার, ইচ্ছে হতো সব ভুলে ওর মাথাটা বুকের ভেতর চেপে ধরে রাখি ।
আমি শুধু অর্ককে চাইতাম, আমার সবকিছু দিয়ে শুধুই ওকে পেতে চেয়েছি আমি। ভেবেছিলাম বিয়ের পরদিনই মজার মজার সব রান্না করে চমকে দেবো ওকে, বলবো কিরে কি মনে হয় আমিও পারিতো ? অর্কের জন্য আমার ভালোবাসা ছিলো মাতাল ঝড়ের মতো, আমি শুধু এক একটি করে দিন গুনতাম। মনপ্রাণ দিয়ে ওর বউ হবার কামনা করতাম। অর্ক জানতো আমার ওর জন্য জমিয়ে রাখা উন্মাদ ভালোবাসার কথা । ও প্রায়ই আমাকে বলতো” এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন ? পাগল হয়ে যাবোতো। আমি পাগল হয়ে গেলে পরে লোকে বলবে তোর বর পাগল।
অর্ক পাগল হয়নি, আমাকে পাগল করে দিয়ে চলে গেছে। ওর প্রিয় বৃষ্টির দিনেই সব ছেড়ে চলে গেছে ও অনেকদুর। ফেলে গেছে আমাকে ভীষন একলা এই ভুবনটায়।
কেন অর্ক ! কেন ? তোরতো আকাশ প্রিয় ছিল না, তবুও কেন তুই আমার জন্য আকাশই হয়ে গেলি ! আমার চারপাশটায় এখন নীল আকাশ, চার পাশটাই তুই – সারাক্ষণ দেখতে পাই শুধু ছুতে পারি না । তুই নেই তবুও কেন আমার সারা শরীরে যন্ত্রণা হয়ে তুই বেচে থাকিস ?! তোকে ছাড়া আমার যে সব শুন্য, সবকিছুই আধার । আমিতো শুধু তোর লক্ষী বউ হতে চেয়েছিলাম, জীবনে আর কিচ্ছু চাই নি -তবুও কেন চলে গেলি অর্ক ?
কেমন আছিস তুই আমাকে ছাড়া ?